বগুড়া প্রতিনিধি:
গত ১২ মে বগুড়া জেলা পুলিশের ডিবির একটি দল ঢাকার মিরপুরে অভিযানে এসেছিলছবি সিসিটিভির ফুটেজ থেকে নেওয়া।
রাজধানীর মিরপুরের একটি আবাসিক হোটেলে মাদক কারবারিকে আটকে রেখে ৭ লাখ ৮০ হাজার টাকা আদায় করে ছেড়ে দিয়েছেন বগুড়া জেলা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কয়েকজন সদস্য। গত ১২ মে ঘটনাটি ঘটেছে মিরপুর-২ নম্বরের বড়বাগ এলাকার একটি আবাসিক হোটেলে।
বগুড়া জেলা গোয়েন্দা পুলিশের একাধিক সূত্র প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর ওই মাদক কারবারির কাছ থেকে আদায় করা টাকার পুরোটাই ফেরত দিয়েছেন ডিবি পুলিশের সদস্যরা। তবে ঘটনার দেড় মাস পরও জড়িত পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। টাকা আদায় করে মাদক কারবারিকে ছেড়ে দেওয়ার ঘটনাকে ‘সামান্য অপরাধ’ বলছেন ডিবির কর্মকর্তারা।
বগুড়া ডিবির কর্মকর্তারা বলছেন, ঘটনাটি ঘটেছে উপপরিদর্শক (এসআই) আমিরুল ইসলামের নেতৃত্বে। তাঁরা পাঁচজন ছিলেন। ভিডিও ফুটেজ দেখে অভিযানে থাকা পুলিশ সদস্যদের চিহ্নিত করার পর জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। ভিডিও ফুটেজে আরও চার ব্যক্তিকে দেখা গেছে, যাঁদের বগুড়া জেলা ডিবির কর্মকর্তারা চিনতে পারেননি।
একাধিক ক্লোজড সার্কিট (সিসি) ক্যামেরার ফুটেজে দেখা গেছে, বগুড়া ডিবির সদস্যরা সাদাপোশাকে গত ১২ মে রাতে মিরপুরের বড়বাগ এলাকার ‘গেস্ট হাউস’ নামে আবাসিক হোটেলে মাদক ব্যবসায়ী রুবেল ওরফে পিচ্চি রুবেলকে নিয়ে যান। তাঁরা ২৪ ঘণ্টারও কম সময় ওই হোটেলে অবস্থান করেন। আবাসিক হোটেলের তত্ত্বাবধায়ক শাহিন হাওলাদার প্রথম আলোকে বলেন, ১২ মে রাতে অস্ত্র হাতে কয়েকজন হোটেলে এসে ডিবি পরিচয় দেন। ওই সময় তাঁরা জানিয়েছিলেন, তাঁদের (ডিবি পরিচয় দেওয়া ব্যক্তিরা) একজন রোগী কিডনি হাসপাতালে ভর্তি। তাঁকে দেখতে এসেছিলেন। রাত হয়ে যাওয়ায় পাঁচজন হোটেলে অবস্থান করবেন। ডিবি পরিচয় দেওয়ার কারণে তিনি আর বেশি কিছু জিজ্ঞাসা করেননি।
মাদক কারবারি পিচ্চি রুবেলের বাড়ি ময়মনসিংহের মুক্তাগাছায়। মুক্তাগাছা থানার ওসি ফারুক আহম্মেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘রুবেল সেখানকার একজন চিহ্নিত মাদক কারবারি। তাঁর বিরুদ্ধে তিনটি মাদক মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে। তাঁকে আমরা খুঁজছি।’
এ ধরনের ঘটনায় পুলিশ জড়িত হলে, সেটাকে সামান্য অপরাধ বলার সুযোগ নেই। জড়িতদের চাকরিচ্যুত করা উচিত।
নূর মোহাম্মদ, পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক
এ বিষয়ে কথা বলার জন্য গত ৩০ জুন বগুড়া ডিবি কার্যালয়ে গিয়ে অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া আমিরুল ইসলামকে পাওয়া যায়নি। ডিবি কার্যালয় থেকে জানানো হয়, তিনি প্রশিক্ষণে আছেন। পরে আমিরুলের মুঠোফোনে দফায় দফায় যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। মুঠোফোন এবং হোয়াটসঅ্যাপে প্রশ্ন লিখে বক্তব্য জানতে চাওয়া হলেও তিনি কোনো উত্তর দেননি।
‘সামান্য অপরাধ দেখছে ডিবি’
বগুড়া জেলা ডিবির ওসি মুস্তাফিজ হাসান প্রথম আলোকে বলেন, এ অভিযানের বিষয়ে তাঁরা কিছু জানতেন না। বগুড়ার পাঁচ পুলিশ সদস্যকে নিয়ে গেছেন আমিরুল ইসলাম। তিনি জয়পুরহাট জেলা থেকে কিছুদিন আগে বগুড়ায় যোগ দেন। আটক হওয়া ব্যক্তি এসআই আমিরুলের সোর্স (তথ্যদাতা) ছিলেন। তথ্যপ্রাপ্তির জন্য আমিরুল ওই ব্যক্তিকে দেড় লাখ টাকা দিয়েছিলেন। কিন্তু ওই ব্যক্তি তথ্যও দিচ্ছিলেন না, আবার টাকাও ফেরত দিচ্ছিলেন না। এ জন্য তাঁকে আটক করে কিছু টাকা আদায় করেছিলেন আমিরুল।
ডিবির ওসি মুস্তাফিজের ভাষ্য, কথিত অভিযানের বিষয়টি তাঁকে একজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জানিয়েছিলেন। ওই মাদক কারবারি ওই অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের আত্মীয়। পরে এসআই আমিরুলকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তবে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা আছে, এমন একজন মাদক কারবারি পুলিশের তথ্যদাতা হতে পারেন কি না, এ বিষয়ে তিনি (মুস্তাফিজ হাসান) বিষয়টি এড়িয়ে যান। আর একজন এসআই দেড় লাখ টাকা সোর্স মানি (তথ্যদাতাকে দেওয়ার জন্য সম্মানী) পান কি না জানতে চাইলে পরিদর্শক মুস্তাফিজ হাসান বলেন, ‘এটা হতে পারে।’
বগুড়া ডিবির পরিদর্শক মুস্তাফিজের ভাষ্য, এভাবে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের না জানিয়ে একটি টিম নিয়ে ঢাকায় যাওয়ার সুযোগ নেই। যদি ডিবির কোনো দল কোথাও অভিযানে যায়, তবে তাঁকে জানিয়ে যেতে হবে। আমিরুলের নেতৃত্বে ডিবির দলটি তাঁকে না জানিয়ে ঢাকায় গিয়ে অপরাধ করেছে। তবে মাত্রাগত দিক থেকে এটা ‘সামান্য অপরাধ’ বলেই মনে করেন তিনি। তবে এ অপরাধের কারণে আমিরুলকে তেমন শাস্তির মুখোমুখি করা হবে না। অন্যত্র বদলি করা হবে। কারণ, এই অপরাধে ব্যবস্থা নিলে ডিবির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে।
তবে বগুড়া জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার স্নিগ্ধ আখতার গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, এমন কোনো অভিযানের কথা তাঁর জানা নেই। যদি এ রকম হয়ে থাকে, তবে সেটা খতিয়ে দেখা হবে।
‘এমন ঘটনায় চাকরিচ্যুত করা উচিত’
ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের না জানিয়ে অভিযান পরিচালনা করা, মাদক কারবারিকে আটক করে অর্থের বিনিময়ে ছেড়ে দেওয়ার ঘটনাটি নিয়ে যোগাযোগ করা হয় পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক নূর মোহাম্মদের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, একজন পুলিশ সদস্য যে জেলায় কর্মরত, সেই জেলাতেও অভিযান চালালে অনুমতি নিতে হয়। কোথায় যাচ্ছেন, নোট লিখে যেতে হয়। যে ঘটনার কথা বলা হচ্ছে, সেটি সত্য হলে অভিযানে যাওয়া পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। এ ধরনের ঘটনায় পুলিশ জড়িত হলে, সেটাকে সামান্য অপরাধ বলার সুযোগ নেই। জড়িতদের চাকরিচ্যুত করা উচিত।
সুত্র: দৈনিক প্রথম আলো