দৈনিক প্রাণের শহর বিডি ডেস্ক:
ঢাকা, ২ নভেম্বর: বাংলাদেশের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তরের বিনিয়োগ সহায়তা উদ্যোগে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে।
এই তথ্য উপস্থাপন করা হয় ৫ম ইনভেস্টমেন্ট কো-অর্ডিনেশন কমিটির বৈঠকে, যা সভাপতিত্ব করেন প্রধান উপদেষ্টার আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশেষ দূত লতফে সিদ্দিকী। তিনি বলেন, “আমরা এই বৈঠকে বাস্তবায়ন এবং পারস্পরিক জবাবদিহিতার ওপর জোর দিচ্ছি — যা ব্যবসা পরিচালনার পরিবেশ উন্নয়নে আমাদের অঙ্গীকারের প্রতিফলন। আমাদের সামনে অনেক পথ বাকি, কিন্তু আমরা পরিষ্কার উদ্দেশ্য, শৃঙ্খলা ও স্বচ্ছতার সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছি।”
বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ. মনসুর, প্রধান উপদেষ্টার তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ক বিশেষ সহকারী ফাইজ আহমেদ তাইয়্যেব, বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা)-এর নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খানসহ বিভিন্ন সচিব ও বেসরকারি খাতের প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করেন।
ফ্রি অব চার্জ (FoC) আমদানি নীতিতে সংশোধন:
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ১০০% রপ্তানিমুখী কোম্পানির জন্য ফ্রি অব চার্জ (FoC) আমদানিতে কোটাব্যবস্থা বাতিলের নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দুই সপ্তাহের মধ্যে আমদানি নীতি আদেশ সংশোধন সম্পন্ন হবে বলে জানানো হয়। এই সংস্কার কার্যকর হলে মজুদ খরচ উল্লেখযোগ্যভাবে কমবে এবং প্রতিযোগিতা বাড়বে।
বিজিএমইএর মতে, এই নীতি নিঃশর্তভাবে বাস্তবায়ন করা গেলে রপ্তানি আয়ে বহু বিলিয়ন ডলারের ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।
ডিজিটাল অবকাঠামো উন্নয়ন:
একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্জন হলো ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বাংলাদেশ বিজনেস পোর্টালের প্রথম ধাপ উদ্বোধন। এটি বিনিয়োগকারীদের জন্য একক ডিজিটাল গেটওয়ে হিসেবে কাজ করছে। দ্বিতীয় ধাপ, যা ডিসেম্বর ২০২৫-এর মধ্যে সম্পন্ন হবে, সেখানে বিজনেস স্টার্টার প্যাকেজ ও সিঙ্গেল সাইন-অন সুবিধা যুক্ত হবে — যার মাধ্যমে ২৯টি সরকারি সেবা একত্রে পাওয়া যাবে।
এই সিস্টেম পরবর্তীতে বাংলাদেশ সিঙ্গেল উইন্ডো (BSW), ASYCUDA এবং কাস্টমস বন্ড ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (CBMS)-এর সঙ্গে তথ্য বিনিময় সক্ষমতা অর্জন করবে, যা সরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে নজিরবিহীন সমন্বয় সৃষ্টি করবে।
বন্দর ও কাস্টমস আধুনিকায়ন:
চট্টগ্রাম বন্দরে বড় ধরনের পরিবর্তন চলছে। লালদিয়া ইয়ার্ড ও তালতলা কনটেইনার ইয়ার্ড নির্মাণের কাজ এগিয়ে চলছে, যার মধ্যে তালতলার ৬.২৫ একর সুবিধা শিগগিরই চালু হবে।
বর্তমানে বন্দরে আটকে থাকা ৬,০০০-এরও বেশি কনটেইনার অপসারণ উদ্যোগ চলছে। এর মধ্যে প্রায় সব কনটেইনারের ইনভেন্টরি সম্পন্ন হয়েছে এবং ৪০৩টি কনটেইনার ইতোমধ্যে নিলামে বিক্রি করা হয়েছে। বিপজ্জনক পণ্যের নিষ্পত্তি প্রক্রিয়া নির্ধারণে সাত সদস্যের বিশেষজ্ঞ কমিটি কাজ করছে।
অটোমেটেড রিস্ক ম্যানেজমেন্ট সফটওয়্যার (ARMS)-এর এপিআই ইনস্টলেশন চলছে, যা ডেটা-নির্ভর ঝুঁকি মূল্যায়নের মাধ্যমে কার্গো পরিদর্শনে বিপ্লব ঘটাবে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ এখন সরাসরি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সঙ্গে যোগাযোগ করছে, যাতে সমস্যা দ্রুত সমাধান হয় — শিপিং মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে নয়, বরং অনুলিপি পাঠিয়ে।
ব্যাংকিং ও আর্থিক খাতের সংস্কার:
বেসরকারি খাতের অনুরোধে বাংলাদেশ ব্যাংক বন্দরের আশপাশের ব্যাংক শাখাগুলোতে রিয়েল-টাইম গ্রস সেটেলমেন্ট (RTGS) চালু করেছে এবং ২৪ ঘণ্টা পরিষেবা চালুর উদ্যোগ নিচ্ছে।
রপ্তানি-আমদানি লেনদেনের অর্থপ্রবাহের প্রতিটি ধাপের একটি বিস্তারিত ফ্লোচার্ট তৈরি করা হচ্ছে, যা ডিজিটাল মাধ্যমে প্রচারিত হবে।
অগ্রিম অর্থপ্রদানের সীমা, এক্সপোর্ট রিটেনশন কোটা (ERQ)-এর নমনীয়তা এবং টাকায় খোলা হিসাব থেকে ডলার স্থানান্তর নীতিমালা পর্যালোচনায় রয়েছে। এসব সংস্কার বাস্তবায়িত হলে রপ্তানিমুখী শিল্পগুলোর কর্মরত মূলধন ব্যবস্থাপনা সহজ হবে।
ব্যবসা নিবন্ধন ও লাইসেন্সিং সহজীকরণ:
ঢাকা দক্ষিণ, ঢাকা উত্তর, চট্টগ্রাম ও সিলেট সিটি করপোরেশনে উদ্যোক্তাদের জন্য একক প্রবেশ পয়েন্ট স্থাপন করা হয়েছে। স্থানীয় সরকার বিভাগ এই প্ল্যাটফর্মগুলো সারাদেশে সম্প্রসারণের পরিকল্পনা করছে।
উদ্যোক্তাদের সুবিধার্থে ট্রেড লাইসেন্স নবায়নের মেয়াদ এক বছর থেকে বাড়িয়ে পাঁচ বছর করা হয়েছে।
পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (PPP) কাঠামো:
PPP মডেল বাস্তবায়নের জাতীয় কৌশলের খসড়া সম্পন্ন হয়েছে এবং স্টেকহোল্ডার পরামর্শ শেষ হয়েছে। এখন তা পরিকল্পনা কমিশনে চূড়ান্ত অনুমোদনের অপেক্ষায়।
বিনিয়োগ পাইপলাইন ও স্বচ্ছতা:
সব বিনিয়োগ সংস্থা এখন মাসিকভাবে তাদের পাইপলাইন প্রকল্পের তথ্য বিডায় জমা দিচ্ছে। এতে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের ধারা বিশ্লেষণ, প্রকৃত চুক্তিতে রূপান্তর, এবং দেশভিত্তিক বিনিয়োগ প্যাটার্ন নির্ধারণ সহজ হচ্ছে।
বিডা এসব তথ্য একত্রিত করে ইনভেস্টমেন্ট কো-অর্ডিনেশন কমিটিতে উপস্থাপন করে, যাতে প্রমাণ-ভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ সম্ভব হয়।
পরিবেশ ও টেকসই উন্নয়ন:
বিডা, পরিবেশ অধিদপ্তর ও বন বিভাগ যৌথভাবে ডিসেম্বর ২০২৫-এ একটি কর্মশালার আয়োজন করছে, যেখানে কার্বন ট্রেডিং ও বিনিয়োগ সহায়তা বিষয়ে আলোচনা হবে।
ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) সহায়তা:
এসএমই খাতের জন্য বাজার উন্নয়ন, ব্যাংক-নিয়ন্ত্রিত বৈদেশিক অর্থপ্রাপ্তি ব্যবস্থা এবং এসএমই ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে সহায়তা বাড়ানো হচ্ছে।
এই সব সংস্কারের মূল বিষয় হলো — ডিজিটালাইজেশন ও প্রক্রিয়া সরলীকরণ। লক্ষ্য হলো সব অনলাইন সেবা যেন সত্যিকার অর্থে অনলাইনে সম্পন্ন হয় এবং একক প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারে সবাইকে উৎসাহিত করা।
সম্প্রতি এনবিআরের ন্যাশনাল সিঙ্গেল উইন্ডো (NSW) ৬ লক্ষাধিক পারমিট ইস্যু করেছে (এর অধিকাংশই ২৪ ঘণ্টার মধ্যে) এবং প্রায় ১২ লক্ষ সরকারি দপ্তর ভিজিট বাঁচিয়েছে!

